
সংখ্যালঘুরা এখন আতংকের অতীত পেছনে ফেলে উন্নত ভবিষ্যতের প্রত্যাশায়
সাদ্দাম হোসাইন, টেকনাফ ॥
রামুতে পবিত্র কোরান অবমাননার জের ধরে টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠা জনতার হামলার ৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে। বাংলার আকাশে সামপ্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে পুরো দেশকে অশান্ত করার গভীর ষড়যন্ত্র ছিন্ন করে শ্যামল বাংলায় আবার শান্তির সুবাতাস ফিরে এসেছে। সরকারী পৃষ্টপোশকতায় সংখ্যালঘুরা এখন আতংকের অতীত পেছনে ফেলে উন্নত ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছে নিজ বসত-বাড়িতে। সেদিন এই ঘটনা সামলাতে গিয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান নিজেসহ অনেকে আহত হওয়ার পরও রাজনৈতিক কারণে মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বলে দাবী করেন।
আজ ৩০ সেপ্টেম্বর ১৫ইং টেকনাফের হোয়াইক্যংয়ে বড়–য়া পল্লীতে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ৩ বছর পূর্ণ হয়েছে। গত ২০১২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিকাল সাড়ে ৩টারদিকে রামুতে পবিত্র কোরান অবমাননার প্রতিবাদে একটি চক্র বিক্ষোভ মিছিল করার আহবান জানিয়ে মাইকিং করে প্রচারনা চালায় একটি গ্র“প। সম্ভাব্য অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ বড়–য়া মন্দিরে পাহারা জোরদার করে। মিছিল আয়োজনকারী চক্রের কতিপয় সদস্য মাগরিবের আযানের পর পরই বড়–য়া পল্লীতে হামলা করে কোরান অবমাননার প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়ে উঠে। সহজ-সরল ধর্মপ্রাণ মানুষকে উত্তেজিত করে বড়–য়া পল্লীর জুয়ারিয়া খোলা মন্দিরে হামলা চালাতে গেলে পুলিশী বাঁধার মুখে পড়ে এবং বড়–য়া গোত্রের লোকজন পালিয়ে যাওয়ার সময় ৮/১০জন আহত হয়। খবর পেয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেও তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। এমন কি পুলিশের উপর ঝাপিয়ে পড়তেও কার্পন্য করেনি। পরে পুলিশ নিরুপায় হয়ে মন্দির ও আতœরক্ষার্থে প্রায় শতাধিক রাউন্ড ফাঁকাগুলি বর্ষণ করে। এতে চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী, তৎকালীন আইসি-বখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরী, নায়েক-জয়ন্ত বড়–য়া, কনস্টেবল-তুষার, আব্দুর রব, সংবাদ কর্মী রমজান উদ্দিন পটল, আমতলীর আবুল কাশেমের পুত্র মোঃ জাহেদ(১৮), লম্বাবিল এলাকার মিয়া হোছনের পুত্র মোঃ জালাল আহমদ(২৬), আলমের শিশুপুত্র পুতিয়া(৮), আব্দুল হাকিমের পুত্র মোস্তাক, নুরুল ইসলামের পুত্র হাসান আলী, নুরুল আলমের পুত্র মোঃ হোছন ও জসিম নামের যুবকসহ উভয়পক্ষের ২১জন আহত হয়। পরে ক্ষুদ্ধ লোকজন বড়–য়া পাড়ার নির্মল বড়–য়া, সাধন মলি¬ক, যতিন্দ্র, হালু, অমল বড়–য়া, নুনু বড়–য়াসহ ৮/১০টি বসত-বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে এবং ভাংচুর চালায়। এ ঘটনায় ভূতি শর্মা (৭৫)নামে বৃদ্ধা অগ্নিকান্ডে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। হামলায় আহত লোকজনকে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করা হয়। সংখ্যালঘু বড়–য়া পল্লীতে ন্যাক্কারজনক হামলার ঘটনায় হোয়াইক্যং পুলিশের তৎকালীন এএসআই মাহফুজ বাদী হয়ে ৭০ জন এজাহার নামীয় আসামীসহ অজ্ঞাত ২/৩ শত লোককে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করে। পুলিশ ২১জনকে আটক করে হাজতে প্রেরণ করে। জোয়ারী খোলার ক্ষতিগ্রস্থ বাড়ীর মালিক সাধন মল্লিক বাদী হয়ে হোয়াইক্যং ইউপি চেয়ারম্যান নূর আহাম্মদ আনোয়ারীকে প্রধান আসামী করে ৩৩ জন এজাহার নামীয় ও অজ্ঞাত ২ থেকে আড়াই শত লোককে আসামী করে মামলা করে। এরপর শুরু হয় কতিপয় দালাল ও রাজনৈতিক নেতাদের ইন্দনে স্পর্শকাতর মামলার পুলিশী বাণিজ্য। রাতের বেলায় ধরে এনে বোঝা-পরা না হলে মামলায় জড়িয়ে হাজতে চালান দেওয়াসহ কত কি!। পুলিশী আতংকে এলাকার হাজার হাজার নিরীহ মানুষ স্ত্রী,ছেলে-মেয়ে ও বাড়ি-ঘর ফেলে পালিয়ে যেতে থাকে। অনেকে সাগর পথে মালয়েশিয়া যেতে গিয়েই চিরতরে হারিয়ে গেছে। পুলিশ শেষ পর্যন্ত বড়–য়া পল্লীতে হামলা ও অগ্নি সংযোগ মামলায় ৮৬জন এবং সাধন মল্লিকের মামলায় ৬৬জনকে অর্ন্তভূক্ত করে চুড়ান্ত চার্জশীট প্রদান করে। ঐদিনের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের অনেকে পরকালে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারীসহ অনেককে রাজনৈতিক কারণে সেদিনের মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হয়েছিল। এই ব্যাপারে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা জামায়াত নেতা নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন আমিসহ অনেক জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়ে মানবেতর দিন কাটছে। আমরা আগেও সহাবস্থানে ছিলাম এবং এখনো আছি। আগামীতে থাকবো ইনশল্লাহ। তরে যারা নির্দোষভাবে মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে তাদের বিষয়টিও খতিয়ে দেখার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সহায়তা কামনা করেছেন।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ও স্থানীয় এমপির অনুদান পেয়ে পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্থ ১৭ পরিবার পুনরায় উন্নত মানের বসত-বাড়ি নির্মাণ করে নতুন প্রত্যাশায় জীবন চলা শুরু করেছে। তাদের সঙ্গে আলাপকালে জানান গত ২০১২ সালের লোমহর্ষক ও হৃদয়-বিদারক কালো রাত্রির কথা মনে হলে গাঁ শিউরে উঠে। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ যে কত নিষ্ঠুর হয় তা ঐ রাতই প্রথম অভিজ্ঞতা আমাদের। বর্তমানে তারা সরকারী সহায়তা এবং নিজস্ব অর্থায়নে উন্নমানের বাড়ি তৈরী করে সুখে রয়েছে। এ ব্যাপারে স্থানীয় ফাঁড়ির আইসি বলেন ঐ ঘটনার পর হতে বড়–য়া পল্লী,উপাসনালয় এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের প্রতি প্রতিনিয়ত নজরদারী রেখে খোঁজ-খবর নেওয়া হয়।
পাঠকের মতামত